বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- ভূমিকা
- জন্ম
- শৈশব-কৈশোর ও শিক্ষাজীবন
- সাহিত্যকর্ম ও সাহিত্য ভাবনা
- তার রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্য
- বিবাহ ও দাম্পত্য জীবন
- রাজনীতি ও সমাজকল্যাণ
- সমাজগঠনমূলক কাজ
- পুরস্কার ও সম্মাননা
- উপসংহার
ভূমিকা: বাংলাদেশ তথা বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ একটি বিশেষ নাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় সমান প্রতাপের সাথে বাংলা সাহিত্য, ভাষা ও সংস্কৃতিতে সমাসীন রয়েছেন। তাঁর সর্বতোমুখী প্রতিভা, জ্ঞানের গভীরতা তাকে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তিনি এসেছিলেন ক্ষণকালের জন্য কিন্তু হয়ে রয়েছেন সর্বকালের। ভারতীয় হয়েও তিনি বিশ্বের দরবারে আসন গেড়ে নিয়েছেন নিজের মর্যাদা ও যোগ্যতা বলে। ‘বিশ্বকবি’ অভিধায় অভিসিক্ত হয়ে তিনি আছেন সকল মানুষের হৃদয়জুড়ে।
জন্ম: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকোর সম্ভ্রান্ত ঠাকুর পরিবারে ৭ মে ১৮৬১ (২৫ বৈশাখ, ১২৬৮) সালে। তাঁর পিতার নাম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাতা সারদা দেবী। পিতা-মাতার ১৫ সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্দশতম এবং অষ্টম পুত্র।
 |
Pic Source:Google |
শৈশব কৈশোর ও শিক্ষাজীবন: শিশু রবীন্দ্রনাথ বেড়ে উঠেছেন নিতান্তই সহজ সরল ও সাদাসিদেভাবে। একটু বড় হলেই প্রথমে ভর্তি হলেন কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে, কিছুদিন পর চলে গেলেন নর্মাল স্কুলে তারপর বেঙ্গল একাডেমি, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে কিন্তু কোথাও তাঁর মন বসেনি। ঠাকুরবাড়ির রুটিন বাঁধা জীবনে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। অভিভাবকদের নিরালস প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি স্কুলের গন্ডি পার হতে পারেননি। স্থির করলেন মেজভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টার হবেন। লন্ডনে গিয়ে প্রথমে পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হন। কিন্তু পড়াশুনায় মন না থাকায় তাঁর বেশির ভাগ সময় কাটে সাহিত্য চর্চায়। দেড় বছর পর ১৯ বছর বয়সে পিতার নির্দেশে শিক্ষা অসম্পূর্ণ রেখে দেশে ফিরে আসেন। এখানেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের ইতি ঘটে।
সাহিত্যকর্ম ও সাহিত্য ভাবনা: তাঁর লেখালেখির হাতে খড়ি হয় আট বছর বয়সে। ১৩ বছর বয়সে ‘অমৃতবাজার’ নামে দ্বিভাষিক পত্রিকায় (১৮৭৪) ‘হিন্দুমেলার উপহার’ নামে কবিতাটি প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা নেই। কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, প্রভৃতি অবিরাম তিনি লিখে গেছেন। কিন্তু মূলত তিনি কবি এবং কবি হিসেবেই তাঁর খ্যাতি সমধিক, কবির মন নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় ব্যাকুল।
 |
Pic Source:Google |
তার রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্য: মানসী, সোনার তরী, চৈতালী, গীতাঞ্জলি, বলাকা, পুনশ্চ প্রভৃতি; উপন্যাস-চোখের বালি, ঘরে-বাইরে, যোগাযোগ, চতুরঙ্গ প্রভৃতি; নাটক- বিসর্জন, রক্তকরবী প্রভৃতি; ছোটগল্পগ্রন্থ- গল্পগুচ্ছ, এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম লিখে গেছেন।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে অনুভব করা তথা জীবন ও জগতকে উপলব্ধি করার জন্য যে দূরত্ব অতিক্রম করা প্রয়োজন, তাঁর প্রিয়জনের মৃত্যু এই দূরত্ব অতিক্রম করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। যার বহিঃপ্রকাশ ‘কড়ি ও কোমল’ এ পাওয়া যায়-
“মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।”
‘কড়ি ও কোমলে’
এ কবি আত্ম-প্রতিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। কিন্তু মানসীতে পেরেছেন। তাই কবি বলেছেন-
“মানসীতে যাকে খাড়া করেছি যে মানসেই আছে,
সে আর্টিস্টের হাতে রচিত ঈশ্বরের প্রথম অসম্পূর্ণ প্রতিমা।”
বর্তমান বাংলাদেশের পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গে তাদের বিস্তৃত জমিদারী ছিল। এই জমিদারীর ভার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং বাংলার গ্রাম-গঞ্জ, নদীপথ ঘুরে তিনি যে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তা তাঁর রচিত পরবর্তী সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। যার প্রমাণ ‘ভানু সিংহের পত্রাবলী’তে পাওয়া যায়- ‘আমি জীবনের কতকাল যে এই নদীর বাণী থেকেই বাণী পেয়েছি মনে হয় সে যেন আমি আমার আগামী জন্মেও ভুলব না।’রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে গানের প্রসঙ্গ আসবেই, তাঁর কবিতা আসলে গানেরই অনুজ সহোদরা। বিভিন্ন সময়ে লেখা বিভিন্ন কবিতার সমন্বয়ে তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তিনি যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদনায়। যেমন- হিতবাদী, সাধনা, বিচিত্রা প্রভৃতি। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তিনি ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ এর সাথেও যুক্ত ছিলেন। বলা চলে, তিনিই বাংলার ভাষায় প্রথম সার্থক ছোটগল্প লিখেছেন। তাঁর গদ্যে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। তিনি কেবল বিশ্বমানের ছোটগল্প লিখেছেন, তাই-ই নয়, বিশ্বকে ছোটগল্পের নতুন পথও দেখিয়েছেন, তাই এখানে উদ্ধৃতিযোগ্য-
‘নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়েও হইল না শেষ’।
শুধু কবিতা আর গানই নয় পাশাপাশি লিখেছেন একের পর এক কাব্যনাটক, হাস্যরসাত্মক রচনা। এগুলোর পাশাপাশি প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমানের একজন চিত্রশিল্পীও ছিলেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি দুই হাজারের বেশি ছবি এঁকেছেন।
 |
Pic Source:Google |
বিবাহ ও দাম্পত্য জীবন: রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হয় ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর। বিয়ের আগে তার স্ত্রীর নাম ছিল ‘ভবতারিনী’ পরে শ্বশুরবাড়িতে তার নাম বদলে রাখা হয় ‘মৃনালিনী দেবী’। তিনি শিলাইদহে সপরিবারে বহুদিন ছিলেন। পরবর্তীতে কলকাতায় আসার পথে স্ত্রী মৃনালিনী দেবী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অল্পদিনের মধ্যেই মারা যান। রবীন্দ্রনাথের তিন কন্যা ও দুই পুত্র ছিল।
রাজনীতি ও সমাজকল্যাণ: ১৯ শতকের শেষ এবং ২০ শতকের গোড়ার দিকে রবীন্দ্রনাথ সক্রিয়ভাবে রাজনীতি ও সমাজকল্যাণমূলক কাজে জড়িত ছিলেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের কারণে তিনি বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা, সভা-সমাবেশে যোগদান করতেন। এ সময়ে তাঁর রচিত গান বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বিবেচিত-
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি,
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
এছাড়াও তিনি শিলাইদহে অবস্থানকালে কৃষক ও শ্রমজীবীদের জন্য কাজ করেছেন। ১৯১৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ দমননীতির বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ‘নাইট’ উপাধি বর্জন করেন। তাছাড়াও হিন্দু-মুসলিম সংকট, ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজনীতি, বিশ্ব পরিস্থিতি প্রভৃতি নিয়ে তিনি অসংখ্য লেখা লিখেন।
সমাজগঠনমূলক প্রতিষ্ঠান: সাহিত্য রচনার পাশাপাশি তিনি সমাজ গঠনমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শান্তিনিকেতনে ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ নামে একটি আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন। পরবর্তীকালে এটিই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপলাভ করে।
 |
Pic Source:Google |
পুরষ্কার ও সম্মাননা: তিনি তাঁর বহুকৌণিক কাজের পাশাপাশি অর্জন করেছেন অসংখ্য পুরস্কার আর সম্মান-সম্মাননা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ১৯১৩ সালে ডি. লিট উপাধি দেয়। ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও এই উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯১৩ সালে তিনি এশিয়ার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে নোবেল পুরস্কার পান। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টরেট ডিগ্রি দেয় ১৯৪০ সালে।
উপসংহার: রবীন্দ্রনাথ তাঁর দীর্ঘ আঁশি বছরের জীবনে যেমন সাহিত্য রচনা করেছেন তেমনি মর্যাদা এবং সাফল্যও পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সত্যিকার অর্থেই প্রতিভাবান। তিনি তার জীবনের শেষ সময়ে এসেও কবিতা লেখা ছাড়েননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ) মারা যান। রবীন্দ্রনাথের মতো মহাপ্রতিভা সমগ্র বিশ্বেই বিরল। তিনি এক অর্থে মহাসাধক, মহামানব। তিনি ছিলেন সত্য-সুন্দরের কবি। সুন্দরের আরাধনায় তিনি মানবতাকে বিসর্জন দেননি, মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেননি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সব্যসাচী রবীন্দ্রনাথ আমাদের সকলেরই প্রিয় কবি।
- অন্য একটি বই থেকে সংগ্রহ
করা
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
- ভূমিকা
- রবীন্দ্র জীবনী
- কবি রবীন্দ্রনাথ
- প্রাবন্ধিক রবীনা
- নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ
- ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ
- ছােটোগল্পকার রবীন্দ্রনাথ
- রবীন্দ্রসংগীতকার
রূৰীনাথ
ভূমিকা
: রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনা, কর্ম-আদর্শ নিয়ে নানা
আলাপ আলােচনা চলছে। তার
বিচিত্র চিন্তা ও কর্মের
প্রবাহ, বিচিত্র প্রকাশের মধ্যে সাহিত্য রচনায়,
বিচারে ও ব্যাখ্যানে যে
পরিচয়টি আমাদের কাছে ফুটে
ওঠে তা হল তার
কবিপ্রকৃতি। মনেপ্রাণে,
চিন্তায়কর্মে, সুখে-দুঃখে, জীবনে-মরণে রবীন্দ্রনাথের মতাে
সমদৃষ্টিমান কবি-মানুষের পরিচয়
মেলা ভার। সমগ্র
জগৎকে তিনি দেখেছেন ঋষিসুলভ
দৃষ্টিতে, যার মাধ্যমে তিনি
আনন্দ রূপকেই উপলব্ধি করেছেন। তাঁর
কবিপ্রকৃতি সীমার সঙ্গে অসীমের,
খণ্ডের সঙ্গে পূর্ণের, ব্যক্তি
জীবনের সঙ্গে বিশ্বজীবনের চিরন্তন
প্রবাহ উপলব্ধি করে তিনি আকণ্ঠ
ডুব দিয়েছেন, আর আপন অভিজ্ঞতাকে
রূপ দিয়েছেন কাব্য-কবিতায়, গল্পে-উপন্যাসে প্রবন্ধে-সাহিত্যে।
রবীন্দ্র
জীবনী
: রবীন্দ্রনাথ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের
কনিষ্ঠ পুত্র তাঁর জন্ম
২৫ বৈশাখ | ১২৬৮ বঙ্গাব্দে (৭
মে, ১৮৬১)। তিনি
আমৃত্যু নানা স্থানে ঘুরেছেন। বিভিন্ন
স্থানে থেকেছেন আর তার অভিজ্ঞতার ঝুলি
ভরিয়েছেন। সেই
অভিজ্ঞতার ফসল রেখে গেছেন
তার সাহিত্যেকর্মে-সাধনায়। জীবনে
বহু ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য
করেছেন প্রিয়জনদের অকাল মৃত্যু কাছ
থেকে দেখেছেন—পরাধীন ভারতবাসীকে ইংরেজদের
নাগপাশ থেকে মুক্ত করার
জন্য নানা কর্মপন্থা নিয়েছেন—পরিশেষে সাফল্য অর্জন করেছেন। ভারতের
স্বাধীনতা তিনি দেখে যেতে
পারেননি—কিন্তু তিনি জানতেন
ভারতবর্ষ একদিন স্বাধীন হবেই। | শিলাইদহে
জমিদারি দেখাশােনা কালে সাধারণ মানুষের
সান্নিধ্যে এসেছেন—শান্তিনিকেতনে।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন—নিজের কর্মপন্থাকে
বহুদূর বিস্তৃত করে দিয়েছেন।
১৯১৩ সালে সাহিত্য কর্মের
স্বীকৃতিস্বরূপ নােবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আবার। জালিয়ানওয়ালাবাগের
হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নাইট উপাধি ত্যাগ
করেন। বিশাল
কর্মজীবনের । শেষে
২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে (৭
আগস্ট, ১৯৪১) পরলােকগমন করেন
এই প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কবি।
কবি
রবীন্দ্রনাথ
: কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবি জীবনের
বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে চরম | শিখরে
উপনীত হয়েছেন। বিভিন্ন
পর্যায়ে নানা পরিবর্তন ঘটেছে
তাঁর কাব্যে—সীমাকে অতিক্রম
করে তিনি অসীমে পৌঁছেছেন। নিত্যনতুন
সৃষ্টির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ
সাফল্যের তা পৌছেছেন।
কল্পনা-কণিকা-নৈবেদ্য-খেয়া
হয়ে যে নবজীবনের প্রবাহের
সূচনা হয়েছিল গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতালির মধ্যে নিঃশেষে আত্মপ্রকাশ
করেছে। এরপর
বলাকা-পূর সহয়া থেকে
পুনশ্চ, শেষ সপ্তক কাব্যগুলিতে
নবনব চিন্তাধারার কাব্যায়ন ঘটেছে।' পর্যায়ের
কাব্যগুলিতে তার মর্ত প্রীতি
ও মানুষের প্রতি গভীর ভালােবাসা
ও বিশ্বাসের চিত্র ধরা পড়েছে।
ছোটোগল্পকার
রবীন্দ্রনাথ
': রবীন্দ্রনাথ বাংলাছোটোগল্পের পথিকৃৎ। পদ্মাতীরে,
বসবাসকালে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে পরিচিত
হন তিনি। তারই
প্রভাব পড়েছে। তার
অসংখ্যছোটোগল্পে। তার
পােস্ট মাস্টার, একরাত্রে, সুভা, ক্ষুধিত পাষাণ,
দান-প্রতিদান, জীবিত ও মৃত,
স্ত্রীর পত্র, ল্যাবরেটরি, সমাপ্তি,
অতিথি, প্রভৃতি গল্পগুলি অনবদ্য। চরিত্র। চিত্রণে,
নাটকীয় সমাপ্তিতে গল্পগুলি পাঠকের মনে বেশ
রেখাপাত করে। মনস্তত্ত্ব
বিশ্লেষণে। রবীন্দ্রনাথ
অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছোটোগল্পকার।
প্রাবন্ধিক
রবীন্দ্রনাথ:
রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ তার জীবননিষ্ঠ মননের
ভাষা। ভারতী,
সাধনা, বঙ্গদর্শন প্রভৃতি পত্রিকার সম্পাদনাসুত্রেই বেশিরভাগ প্রবন্ধগুলি লেখা। তার
প্রবন্ধগুলি তথ্য ও তত্ত্বে
সুসংবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল, যুক্তি
ও বিচার বিশ্লেষণের তীক্ষ্ণতায়
সমৃদ্ধ। শিল্প-সাহিত্য জিজ্ঞাসা, আর্থ-রাজনৈতিক চিন্তা,
সমাজ সংস্কার সম্পর্কিত সমস্যা, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, শিক্ষা
প্রভৃতি বিষয়ই রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ
সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
নাট্যকার
রবীন্দ্রনাথ
: নাট্য রচনা ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ
তাঁর প্রতিভার সাক্ষর রেখে গেছেন। রূপক-সাংকেতিক নাটকে তার কৃতিত্ব
সর্বজনবিদিত। রক্তকরবী,
রাজা, মুক্তধারা, ডাকঘর প্রভৃতি নাটক
বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখে।
শুধু নাটক রচনা নয়
নাট্যমঞ, নাট্য প্রযােজনা, নাট্যাভিনয়
সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসনীয়। নাটকের
চরিত্র, বিষয়, সংলাপ, সংগীত,
প্রভৃতি ব্যাপারে তাঁর চিন্তাশক্তি ছিল
আধুনিক। এ
ছাড়া রবীন্দ্রনাথ কতকগুলি নৃত্যনাট্য রচনা করেছিলেন, যেমন—শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা প্রভৃতি।
ঔপন্যাসিক
রবীন্দ্রনাথ
: রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের বিষয়বস্তু হল ঊনবিংশ ও
বিংশ শতকের বাঙালির ভাবজীবন। এই
সময়ের ব্যক্তি ও সমাজের দ্বন্দ্ব,
ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব,
ব্যক্তির সঙ্গে সাধারণের দ্বন্দ্ব,
হিন্দু ও ব্রায়ের ভাবসংঘাত,
রাজনীতি ও স্বদেশপ্রেম, ব্যক্তির
অন্তরমুখীনতা, প্রভৃতি রবীন্দ্রনাথের ঔপন্যাসিক চেতনাকে সমগ্রতা দান করেছিল।
তার চোখের বালি’ উপন্যাস
থেকে বাংলা উপন্যাসের মােড়
ফেরার ঘণ্টাধ্বনি সূচিত হয়।
গােরা তার মহাকাব্যিক উপন্যাস। গােরার
মধ্যে সুচিত হয় শিক্ষিত
মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের এক
সময়ের সামগ্রিক রূপ। বঙ্গভঙ্গের
পটভূমিতে রচিত হয় ‘ঘরে
বাইরে’, ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের আঙ্গিক | বৈচিত্র্য অনবদ্য। শেষের
কবিতা’ রােমান্টিক প্রেমের উপন্যাস।
রবীন্দ্রসংগীতকার
রবীন্দ্রনাথ
: রবীন্দ্রনাথ সংগীতকারও বটে। তাঁর
মধ্যে ছিল একটিসংগীত পিপাসু মন—যা
দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন
অসংখ্য রবীন্দ্রসংগীত। আনন্দে,
বেদনায়, | দুঃখে, সুখে, উৎসব
অনুষ্ঠানে, বিরহে মিলনে, জীবনে
মৃত্যুতেও তাঁর রচিত সংগীতগুলি
মানুষকে প্রেরণা দেয়—শান্ত করে,
উজ্জীবিত করে।।
উপসংহার
: রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল এক
ঋষিসত্তা— যে সত্তা দিয়ে
তিনি সমস্ত খণ্ডের | মধ্যে
অখণ্ডকে দেখেছেন, হিংসা বিদ্বেষের মধ্যে
প্রেমকে উপলব্ধি করেছেন, অন্ধকারের মধ্যে আলাের সন্ধান
পেয়েছেন। পরাধীনতার
শৃঙ্খলে দেশবাসীর ক্লীবতা ও দীনতাকে উপলব্ধি
করেছেন। তিনি
ক্ষুদ্র, খণ্ড, দ্বেষ, হিংসা,
দীনতা, ক্লীবতার ঊর্ধ্বে উঠে গভীর মনের
প্রত্যয় নিয়ে শাশ্বত সনাতন
জীবনের কথা শুনিয়েছেন।
তাই তার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
জানাতে গিয়ে তার সেইসব
চিন্তা ও মানসিকতার শরীক
হতে হবে আমাদের।
তার মতাে রূপসাগরে ডুব
দিয়ে অরূপের সন্ধান করতে
হবে।
0 Comments