প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ
- ভূমিকা
- জন্ম ও অধ্যয়ন
- কাব্য সাধনা
- শতবর্ষের ভাবনা
- উপসংহার
ভূমিকা : রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলা কাব্য গগনের মধ্যমণি, যখন রবীন্দ্র-প্রতিভার অন্তরাল কাটিয়ে কোনাে স্বতন্ত্র প্রতিভার বিকাশ ছিল অসম্ভব, তখন বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হলেন। এক আলােকসামান্য কবি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তার কবিতা পড়ে বলে উঠলেন—চিত্ররূপময়। আধুনিক বাংলা কবিতার সাম্রাজ্যে এলাে নতুন জীবনের স্পন্দন। ভাবে, ব্যঞ্জনায়, শিল্পকৌশলে তিনি হয়ে উঠলেন নবযুগের রূপকার। ত্রিশােত্তর বাংলা কবিতার এই ঋদ্ধিমান। | স্থপতি কবি জীবনানন্দ দাশ। ১৯৯৯ সাল ছিল তাঁরই জন্ম শতবর্ষ।
Pic Source: Google |
জন্ম ও অধ্যয়ন : ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি অধুনা বাংলাদেশের বরিশাল শহরে কবির জন্ম। বরিশালে জন্ম হলেও কবির পিতামহ সর্বানন্দ দাশ ছিলেন ঢাকা জেলার বাসিন্দা। বরিশালে এসে তিনি ব্রাত্মধর্মে দীক্ষিত হন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেই সূত্রে জীবনানন্দের অধ্যয়ন জীবনের সূত্রপাত বরিশালে। সেখানকার ব্রজমােহন স্কুলে ও কলেজে পড়াশুনাে করে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হন। অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. পাশ করে অধ্যাপনা জীবনে প্রবেশ করেন। | অধ্যাপনা জীবনে তিনি কলকাতার সিটি কলেজ, দিল্লির রামযশ কলেজ, বরিশালের ব্রজমােহন কলেজ, খড়গপুর কলেজ, বরিশা কলেজ ও হাওড়া গার্লস কলেজ আলােকিত করেন। কর্মজীবনে অল্প কিছু সময় ‘স্বরাজ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রাতঃভ্রমণকালে ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর এই প্রথিতযশা কবির অকালপ্রয়াণ ঘটে।
কাব্য সাধনা : জীবনানন্দ দাশের কবিপ্রতিভা জন্মগত। তার রক্তের গভীরে নিহিত ছিল। অবতার বীজ। তার মা কুসুমকুমারী আক্ষেপ করে লিখেছিলেন—
“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে।
কথায় না বড়াে হয়ে কাজে বড়াে হবে।
মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন
মানুষ হইতে হবে এই যার পণ”।
Pic Source: Google |
সেই
আকাঙক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে কাব্যসাধনায় মনােনিবেশ
করলেন জীবনানন্দ। আধুনিক
বাংলা কবিতার প্রথাগত রীতি
ও মূল্যবােধকে পরিহার করে তিনি
রচনা করলেন বুদ্ধিমনস্ক কবিতা। আবেগের
সঙ্গে বুদ্ধির, কাব্যরীতির সঙ্গে গদ্যরীতির মেলবন্ধন
করে তিনি এমন এক
পথের সন্ধান দিলেন, যা
আজও বাংলা কবিতার অন্যতম
রাজপথ। এই
পথে তাঁর সহযােগী হলেন
কবি বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত,
বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী
প্রমুখ কাব্যশিল্পী। প্রথম
কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হলে কাব্যজগতে আলােড়ন
সৃষ্টি হয়। একে
একে প্রকাশিত হয় ‘মহাপৃথিবী’, ‘বেলা অবেলা কালবেলা’, ‘ধূসর
পাণ্ডুলিপি’, ‘রূপসী
বাংলা, ‘বনলতা সেন।
কবিতার কথা তার একমাত্র
প্রবন্ধ সংকলন। আধুনিক
যুগ যন্ত্রণা, হতাশা, নাগরিক অভিঘাত
ও বিষন্নতা কবি জীবনানন্দ দাশের
কবিতায় ছায়া ফেলেছে।
সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে
তার ইতিহাস চেতনা, পরাবাস্তবতা
এবং অস্তিত্ববাদী দর্শন। তিনি
লিখেছেন—
“চারিদিকে
শান্তবাতি ভিজে গন্ধ মৃদু
কলরব
খেয়া নৌকাগুলাে এসে লেগেছে চরের খুব কাছে।
পৃথিবীর এই সব গল্প
বেঁচে রবে চিরকাল
এশিরিয়া ধুলাে আজ ব্যাবিলন ছাই হয়ে গেছে।”
জীবনানন্দ তাঁর প্রিয় বাংলাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। তাই বাংলার তরুলতা, ফল, পাখি তাঁর কবিতায় নানাভাবে উঠে এসেছে। শঙ্খ চিল, শালিক, দোয়েল, মাছরাঙা, ঘঘ যেমন উপজীব্য হয়েছে, তেমনি কবিতার অনুষঙ্গ হয়েছে আকন্দ, বাসক, ফণীমনসা, হিজল প্রভতি গাছপালা। মত্যর পরেই তিনি শঙ্খ চিল, শালিক হয়ে বাংলার মাটিতে গুঞ্জন চেয়েছেন।
উপসংহার : জীবনানন্দ আজ বেঁচে নেই, কিন্তু তার সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তিনি আজও আমাদের চৈতন্যের আলােক শিখা। পরিতাপের বিষয় হলেও সত্যি যে, জীবনানন্দ আমাদের দেশে এখনও উচচ শিক্ষার পাঠ্য-বিষয়। সাধারণ মানুষের কাছে তাকে নিত্যপাঠ্য করে তােলার কোনাে পরিকল্পনা আজও গৃহীত হয়নি। আমাদের উচিত এ ব্যাপারে তৎপর হওয়া। আজ তার জন্ম শতবর্ষ পার করে আমাদের থাকার করতেই হবে জীবনানন্দই হতে পারেন আমাদের আত্মপরিচয়ের স্মারক, আমাদের শ্রমক্লান্ত জীবনের লাবণ্যময় আশ্রয়, আমাদের রুপসী বাংলার রাষ্ট্রদূত।
0 Comments