একটি ছাতার আত্মকথা | একটি ভাঙ্গা ছাতার আত্মকথা | বাংলা রচনা | প্রবন্ধ রচনা | মাধ্যমিক রচনা | রচনা | অনু‌চ্ছেদ | অনু‌চ্ছেদ রচনা |

কিছু কিছু তুচ্ছ জিনিস সময় বিশেষে বিশেষ প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। তাদের মধ্যে অন্যতম হল ছাতা। মাথার উপরে থেকে রোদ বৃষ্টি থেকে আমাদের রক্ষা করে এসেছে যে ছাতা,তাকে কেন্দ্র করেই আমাদের আজকের উপস্থাপন একটি ছাতার আত্মকথা রচনা। 

একটি ছাতার আত্মকথা
Pic Source: Pixabay

ভূমিকা:

আমি এমন একটি বস্তু যাকে মানুষ নিজের সাধারণ নজরে অতি তুচ্ছ বলে মনে করে। আবার সেই অতি তুচ্ছ বস্তুই কোন কোন সময় মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় একটি দ্রব্য বলে পরিগণিত হয়। আমি হলাম মানুষের কাছে অতি তুচ্ছ, আবার সময় বিশেষে অতি প্রয়োজনীয় একটি ছাতা। মানুষের জীবনে সব সময় আমার স্থান তাদের মাথার উপরে।

আমি মানুষকে রোদ বৃষ্টি থেকে রক্ষা করি। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন অতি সাধারণ ভাবে ছাতা নই। কেন নই তা এই প্রতিবেদনের কোন এক অংশে নিশ্চয়ই ব্যক্ত করব। তবে আমার প্রাথমিক পরিচয় হলো আমি একটি ছাতা। আমি আমার জীবন দিয়ে সব সময় মানুষের সেবা করি।

যে রোদ মানুষ সহ্য করতে পারে না, আমি প্রতিনিয়ত সেই রোদে পুড়ি; যে বৃষ্টি মানুষকে ভিজিয়ে দেয়, আমি মানুষের মাথার উপরে দাঁড়িয়ে সেই অবিরাম ধারায় ভিজি। এতদসত্ত্বেও ঘরে আসার পরেই আমার প্রতি মানুষের চরম অযত্ন। অতি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ঘরের কোনায় কোনায় আমি পড়ে থাকি। শুধুমাত্র প্রয়োজনের সময়ই আমার খোঁজ পরে। 

একটি ছাতার আত্মকথা
Pic Source: Pixabay


ছাতার ইতিহাস ও আমার জন্ম বৃত্তান্ত:

আমার জন্ম বৃত্তান্ত সম্পর্কে জানার পূর্বে আমাদের ছাতা জাতির ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করা বিশেষভাবে প্রয়োজন। ছাতাদের উদ্ভব নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন মত প্রচলিত রয়েছে। কেউ মনে করেন প্রায় ৪০০০ বছর আগে চীন দেশে আমাদের উৎপত্তি; আবার কেউ মনে করেন প্রাচীন গ্রিক কিংবা মিশরীয় সভ্যতা আমাদের প্রথম উদ্ভব।

তবে উদ্ভব যেখানেই হোক না কেন মানুষ প্রথমবার আমাদের ব্যবহার করেছিল বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য নয়, বড় রোদের তাপ থেকে রক্ষা পাবার জন্য। তাই আমাদের ছাতা জাতির ইতিহাস এই পৃথিবীতে অতি প্রাচীন এবং গৌরবময়। এবার আসি আমার জন্ম বৃত্তান্ততে। আমার জন্ম শহর কলকাতার একটি ছাতার কারখানায় অবাঙালি একজন কারিগরের হাতে।

কলকাতার এক বিশেষ ব্যক্তির অনুরোধে অতি যত্ন সহকারে সেই কারিগর আমায় তৈরি করেছিলেন। সুন্দর নকশা কাটা জলনিরোধী কাপড় আর কাঠের উপর নিচের দিকে রুপোর হাতল দিয়ে তৈরি আমার শরীর। এইভাবে একদিন দুপুরবেলায় এক সৌম্যদর্শন পুরুষের হাতে আমি প্রথম চোখ মেলে তাকালাম।

বিশ্বে জায়গাভেদে আমাদের রূপ:

এই পৃথিবীতে বিভিন্ন জায়গায় মানুষের মতোই আমাদের রুপও ভিন্ন ভিন্ন। বিভিন্ন জায়গায় ছাতার কারিগররা তাদের নিজস্ব শৈল্পিক সত্তাকে কাজে লাগিয়ে আমাদেরকে বিভিন্ন রকম রূপ দেন। কোন জায়গার ছাতা বড় বড়, আবার কোথাও বা আমাদের রূপ ছোট এবং বাহারি।

কোথাও আমাদের শরীরে ব্যবহার করা হয় কাঠের হাতল, কোথাও বা ব্যবহৃত হয় ধাতুর তৈরি হাতল। সাধারণত রোদ, জল, বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাবার জন্য আমাদেরকে ব্যবহার করা হলেও শীতপ্রধান বিভিন্ন দেশে তুষারপাত থেকে বাঁচার জন্য আমরা মানুষের সহায় হই।

একটি ছাতার আত্মকথা
Pic Source: Pixabay

আমার জীবন:

যাইহোক, আমি প্রথম যখন চোখ মেলে তাকালাম তখন দেখলাম আমার মালিক একজন সৌম্যদর্শন সাহেব যার মাথা জোড়া বিস্তৃত টাক, সাহেবের শরীর খানিক স্থূল এবং বুঝতে পারলাম ভারতবর্ষের এই উষ্ণ পরিবেশে অনভ্যস্ত সাহেবের শরীর এই গরমে হাঁসফাঁস করছে। যথারীতি আমি আমার কাজে লেগে পড়লাম।

মাথার উপর ডানা মেলে প্রসারিত হয়ে সাহেবকে বাঁচাতে থাকলাম রোদ থেকে। সেদিনই জেনেছিলাম এই সাহেব কলকাতার একটি রাস্তায় একটি ঘড়ির দোকান চালান। ভারতের এই গরমে আমি ছিলাম প্রায় সর্বক্ষণ তার সঙ্গী। জীবনের এক পর্যায়ে জানতে পেরেছিলাম সেই সাহেবের নাম হল ডেভিড হেয়ার। ইনি পরবর্তীকালে কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

আমাকে সঙ্গী করে হেয়ার সাহেবের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় সকলের প্রিয় ঐতিহ্যশালী হিন্দু স্কুল। সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে আমি সাহেবকে দেখতাম সাধারণ ভারতীয়দের মতন সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করতে। আমার এই বিশেষ মালিকানার কারণেই শুরুতে বলেছিলাম আমি কোন সাধারণ ছাতা নই। 

অবসর গ্রহণ:

একটি বৃষ্টির দিনে হেয়ার সাহেব আমায় নিয়ে বেরোতে কোনো কারণে ভুলে গিয়েছিলেন। সেদিন যখন তিনি বাড়ি ফিরে এলেন তখন দেখতে পেলাম তার সর্বাঙ্গ বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছে। তার অববাহিত পরের দিনই হেয়ার সাহেব জ্বরে পড়লেন। বৃষ্টিতে ভেজা, চূড়ান্ত অনিয়ম এবং শহরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়া মহামারীর কারণে হেয়ার সাহেবের শরীরে কলেরা ধরা পড়ল। শত চেষ্টা সত্ত্বেও আমার সেই পরম প্রিয়' মালিককে বাঁচানো গেল না।

তার মৃত্যুর পর আমি অনাথ হয়ে গেলাম। তিনি আমাকে অতি যত্ন সহকারে ঘরের একটি সুন্দর কোনায় রেখে দিতেন। তার চলে যাওয়ার পর আমার খোঁজ আর কেউ রাখলো না। সময়ের সাথে সাথে আমার শরীরে জমলো ধুলো ময়লা, লাগলো মলিনতার ছাপ। আমার মালিক হেয়ার সাহেব ইহলোক ত্যাগ করে আমায় মুক্ত করে আদপে যেনো আমার জীবনের গতি রুদ্ধ করে দিয়ে গেলেন। 

একটি ছাতার আত্মকথা
Pic Source: Pixabay

উপসংহার:

আমি চিরদিন হয়তো হেয়ার সাহেবের ঘরের সেই কোনায় স্থবির, অচল হয়েই পড়ে থাকতাম, যদি হেয়ার সাহেবের একদল অনুরাগী বহুদিন পর এসে সেই ঘর খুলে সাহেবের সকল জিনিসপত্র নিয়ে তারই প্রতিষ্ঠিত হিন্দু স্কুলের একটি সাজান ঘরে এনে স্থান না দিত। সেই দিন হেয়ার সাহেবের স্মৃতিতে আমাকে সাজিয়ে রাখা হলো একটি সুন্দর ছাতাদানিতে।

মালিকের সৌজন্যে দেরি করে হলেও আমার এই সম্মান সাহেবের প্রতি আমার গর্বকে যেন আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিল। বর্তমানে এখানে পুরোদস্তুর স্থাপিত হয়েছে ডেভিড হেয়ার স্মৃতি মিউজিয়াম। এখন এখানে আমি আমার অতীত বেলার সব স্মৃতি নিয়ে হেয়ার সাহেবের ব্যবহৃত অন্যান্য সকল জিনিসের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি; হয়তো দাঁড়িয়ে থাকবো আমার অনন্তকাল পর্যন্ত।


একটি ছাতার আত্মকথা রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার।এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান।দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Post a Comment

0 Comments