ভারতে পণপ্রথা ও নারী নির্যাতন | পণপ্রথা-তার প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি | বাংলা রচনা | প্রবন্ধ রচনা | মাধ্যমিক রচনা | রচনা | অনু‌চ্ছেদ | অনু‌চ্ছেদ রচনা |

ভারতে পণপ্রথা ও নারী নির্যাতন


ভূমিকা : অসহায় ভারতীয় নারীর জীবন যুগ যুগ ধরে খুঁজছে প্রেম-প্রীতিঘন একটি সুখী সচ্ছল গৃহকোণ। কিন্তু কোনােদিন পায়নি। দুদয়হীন স্বার্থপর, পক্ষপাতদুষ্ট, পুরুষশাসিত নিষ্ঠুর সমাজের লােভ-লালসায় ঘৃণ্য পৈশাচিক উল্লাসে ভারতীয় নারীর প্রেম-প্রীতিময় নীড় রচনার স্বপ্ন বারে বারে ভেঙ্গে গেছে। বারে বারে নারী তার জীবনের ব্যথা-বেদনার অভিশাপ মাথায় নিয়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে চরম দুর্ভাগ্যের তীরে। সেখানে সে পণ্য বিকিকিনির নিজ মানদণ্ডে হয়েছে স্বর্ণ রাগকসের শাসন পীড়ন, অত্যাচার, নিগ্রহের নির্মম শিকার। অবশেষে মৃত্যুর কোলেই সে খুঁজে পেয়েছে তার পার্থিব গ্যথা বেদনার সমাপ্তি। ভারতের বহু কলচ্কিত পণ প্রথার জগদ্দল পাষণভার বুকে নিয়ে এইভাবে ভারতীয় নারী যুগ যুগ ধরে করুণ কণ্ঠে কাতর আর্তনাদ করেছে—তার করুণ আর্তনাদে পাষাণ গলেছে—কিন্তু সমাজের বুকে জাগেনি বিন্দুমাত্র বেদনা সহানুভূতি বা সমবেদনা।
ভারতে পণপ্রথা ও নারী নির্যাতন


ভারতীয় নারী সমাজ। বৈদিক ও বৈদিকোত্তর যুগে : প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম লীলাভূমি এই ভারত। প্রাচীনকাল থেকেই সমগ্র পৃথিবী তার দিকে সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে এসেছে। নারীকে সে চিরকালই শ্রদ্ধার স্বীকৃতি জানিয়ে এসেছে। ব্রয্বাদিনী, লােপামুদ্রা, বিশ্বস্তরা, গা্গী, মৈত্রেয়ী, অরুন্ধতী, প্রমুখ মহীয়সী ভারতীয় নারীর নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে।

মধ্যযুগের ভারতীয় নারী : মধ্যযুগে নারী হল পর্দার অন্তরালবর্তিনী। বাইরের জগতে সূর্য উঠেছে—সূর্য ডুবেছে—পৃথিবীর ইতিহাসে নব নব অভ্যুদয়ের জয়ধ্বনি বিঘােষিত হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় নারী সমাজের তিমিরা্ধকার আজও কাটেনি। তারা যে তিমিরে ছিল আজও সেই তিমিরে রয়ে গেছে।

আধুনিক যুগে ভারতীয় নারী মুক্তি আন্দোলন মুসলমান যুগের অবসানে প্রবল ইংরেজ এদেশে এসেছে। কিন্তু সংঘাত শুরু হল ইউরােপের অনুকরণে। ইউরােপের জলম শিক্ষা- সংস্কৃতি ও সভ্যতার অভিঘাত লাগে নির্যাতিত নারী সমাজের উপকূলে। রাজা রামমােহন রায় লর্ড বেন্টিকের সহায়তায় সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ আইন আনলেন; বিধবাবিবাহ ও নারী শিক্ষার প্রবর্তন আনলেন দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর। কিন্তু পণপ্রথা? ইতিহাসে পণপ্রথার বিবুদ্ধে কােনাে আন্দোলন সংগঠিত হয়নি কোনো মহাপুরুষ ভারতের নারী জাতিকে পণপ্রথার যুলকাছে বলি হওয়া থেকে বাঁচাতে পারেননি।

পণপ্রথা-তার প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন। এ কারণেই বিবাহে, এবং পরিবারে পুরুষ ও নারীর সমান গুরুত্ব, সমান মর্যাদা। কিন্তু পুরুষ শাসিত সমাজে নারী পুরুষের অসম অনুপাতের জন্য অতি প্রাচীনকাল থেকেই পণপ্রথা সমাজের বুকে তার শিকড় চালিয়ে বসবার সুযােগ পেয়েছে। যেকোনাে পিতার কাছে কন্যা সন্তান একটি দুঃসহ বােঝা, অবাতি অভিশাপ। কৌলিন্য প্রথা ও জাতিভেদ প্রথার জন্য পণপ্রণা দিনে দিনে স্ফীতকায় হয়ে উঠেছে। আর তারই ফলে সমাজের এক শ্রেণির মানুষের লােভ-লালসা হয়ে উঠেছে অমানুষিক।

আবার বিবাহের পণ অনাদায়ে চলে অসহায় বধূর ওপর অকথ্য অত্যাচার, পীড়ন ও নির্যাতন এবং তার পরিণাম হয় নৃশংস হত্যা বা আত্মহত্যা। প্রতিদিনের সংবাদপত্রে নারী নির্যাতনের একটি ভগ্নাংশ মাত্র প্রকাশিত হয়। লোকচক্ষুর অন্তরালে কত ফুল যে অকালে ঝরে যায় তার হিসাব কে রাখে?

প্রতিকারের উপায় : পণপ্রথা একটি সামাজিক অপরাধ। এই অপরাধের মূলােচ্ছেদ করার জন্য চাই একটি সুস্থ সামাজিক পরিবেশ। ১৯৮৯ সালে পণপ্রথার অবলুপ্তির জন্য আইন পাশ হয়। একটি তদন্ত শেলও গঠিত হয়েছে। কিন্তু সারা দেশে বছরে প্রায় ১০,৫০০ নারীকে পণপ্রথার যুপকাষ্টে প্রাণ দিতে হয়। এর সংখ্যা আবার হিন্দি বলয়ে খুবই বেশি। তাই আইনের রূপায়ণের পাশে পাশে সামাজিক বিবেকবােধের বিকাশ দরকার—দরকার নারী শিক্ষার ও প্রগতির।

উপসংহার : আজ কেবল ঈশ্বরের কাছে নালিশ বা প্রার্থনা নয়—নিজের ভাগ্যকে জয় করার অধিকার অর্জনে নারীকেই হতে হবে অগ্রণী। তাদের বলতে হবে

আমি নারী আমি মহিয়সী,
আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্নাবীণায় নিদ্রাবিহীন শশী।
আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা ওঠা, মিথ্যা হত কাননে ফুল ফোটা।
তাদের শিক্ষা-দীক্ষায় এবং আর্থিক দিক দিয়ে হতে হবে সাবলম্বী। আর ভারতীয় যুব সমাজকেও হতে হবে উদার। সামাজিক দেনাপাওনার ঘৃণিত পণ্যে পরিণত না হয়ে হতে হবে আদর্শ প্রেমিক ও দায়িত্বশীল স্বামী।

Post a Comment

0 Comments